মানসিক সমস্যার লক্ষণ ও চিকিৎসা
‘মানসিক রোগ’ শব্দটির সাথে আমরা হয়তো সবাই পরিচিত। তবে মানসিক স্বাস্থ্যর ব্যাপারে আমরা এখনো ততোটা সচেতন নই এটা হলফ করেই বলা যায়। শরীরের রোগ বাইরে থেকে দৃশ্যমান তাই আমরা খুব সহজেই সেটা বুঝতে পারি ও চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান করতে পারি। তবে মনের ও কিন্ত রোগ হয়! আর সেটা বাইরে থেকে দেখা যায়না বলে আমরা সেটা ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারিনা। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা না থাকায় অনেকেই এটিকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেন। কিন্ত সঠিক চিকিৎসার অভাবে এটি কখনো কখনো বড় আকার ধারন করে এবং রোগীর ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যহত করতে পারে।
আমাদের আজকের আর্টিকেলের শিরোনাম দেখে হয়তো নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে, আমরা কি নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আজকের আর্টিকেলে আমরা , মানসিক সমস্যার লক্ষন, মানসিক সমস্যার ধরন , মানসিক রোগের চিকিৎসা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তবে চলুন, কথা না বাড়িয়ে দেখে নেই আমাদের আজকের আর্টিকেলটি।
আলোচ্য বিষয়
- মানসিক রোগ কি?
- মানসিক সমস্যার লক্ষন
- মানসিক সমস্যার ধরন
- মানসিক রোগের চিকিৎসা
- মানসিক রোগ হলে করনীয়
- মানসিক সমস্যা সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নোত্তর
- আমাদের শেষ কথা
মানসিক রোগ কি?
মানসিক সমস্যা বা মানসিক রোগ হল এমন একটি অবস্থা যা একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং আচরণকে প্রভাবিত করে থাকে। মানসিক রোগ একজন ব্যাক্তির এমন একটি অভ্যন্তরীন সমস্যা যা সেই ব্যাক্তির স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যহত করতে এবং তাকে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করে দিতে সক্ষম। সহজ ভাষায় বলতে গেলে মানসিক রোগ হলো মনের রোগ যার দরুন একজন ব্যাক্তি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়।
মানসিক সমস্যার লক্ষন
মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলি বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য কিছুটা পরিবর্তিত বা ভিন্ন হতে পারে। এছাড়া নির্দিষ্ট রোগের ধরন অনুযায়ী মানসিক রোগের লক্ষনগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। নিচে মানসিক রোগের কিছু লক্ষন তুলে ধরা হলো।
- চিন্তাধারার পরিবর্তন: উদাস থাকা, অতিরিক্ত হতাশা, উদ্বিগ্ন, নিরাশ বোধ, আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা করা ইত্যাদি।
- আচরণে পরিবর্তন: অধিক ঘুমানো বা একেবারেই না ঘুমানো, সামাজিক দূরত্ব যেমন; পরিবার, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সাথে দূরত্ব রেখে চলা, অতিরিক্ত খাওয়া বা একেবারেই খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, পছন্দের কাজগুলিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে শক্তিহীন অনুভব করা, কোনো কাজ বার বার করে করা যেমন; বারবার হাত ধোয়া ও একই কথা বারবার বলা ইত্যাদি।
- শারীরিক উপসর্গ: মাথাব্যথা বা বুকে ব্যথা, হঠাৎ করে ওজন অনেক কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া , নিঃশক্তি হয়ে পড়া ইত্যাদি।
মানসিক সমস্যার ধরন
মানসিক সমস্যার অনেকগুলি ধরন রয়েছে, আমরা এ অংশে এরকমই কিছু ধরন নিয়ে আলোচনা করবো।
- বিষণ্ণতা (Depression) : দীর্ঘস্থায়ীভাবে দুঃখ এবং হতাশা অনুভব করা।
- উদ্বেগ (Anxiety disorder) : সবসময় ভয়, এবং উদ্বেগ অনুভব করা।
- হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD): মনোযোগের অভাব, অতিরিক্ত কার্যকলাপ (যেমনঃ বারবার করে হাত ধোয়া, বার বার যেকোনো জিনিস চেক করা ইত্যাদি ) এবং আবেগগত অস্থিরতা।
- বাইপোলার ডিসঅর্ডার (Bipolar disorder) : অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস অতিরিক্ত শক্তি অনুভব করা, নিম্ন মেজাজ (বিষণ্ণতা) এই সমস্যার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
- স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizofrenia) :এক্ষেত্রে রোগী বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, অদ্ভুত আচরণ করা, অদ্ভুত কিছু অনুভব করা , অদ্ভুত কিছু দেখা বা বিশ্বাস করা যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। স্কিজোফ্রেনিয়া একটি গুরুতর মানসিক রোগ।
- অ্যাডাল্ট অ্যাডাপটিভ ডিসঅর্ডার (AAD): মানসিক চাপের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা।
মানসিক রোগের চিকিৎসা
মানসিক রোগের চিকিৎসা নির্দিষ্ট রোগের অবস্থা এবং ধরনের উপর নির্ভর করে। এখানে মানসিক রোগের সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা হলো।
- ঔষধ: মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতির মধ্যে ঔষধ অন্যতম। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলির (সেরোটোনিন, ডোপামিন, নোরড্রেনালিন ইত্যাদি) মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে ঔষধের ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
- থেরাপি: থেরাপি একজন মানসিক রোগীর চিন্তাভাবনা, আবেগ এবং আচরণকে পরিবর্তন করতে সাহায্য করে থাকে। এটি মানসিক রোগের চিকিৎসার একটি গুরুত্বপুর্ন অংশ। থেরাপি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন; কগনিটিভ বিহেভিয়াল থেরাপি (CBT), ফ্যামিলি থেরাপি, গ্রুপ থেরাপি , সাইকো ড্রামা ইত্যাদি। এটি ব্যাক্তির রোগের ধরন ও অবস্থার উপর নির্ভর করে ব্যাক্তির উপর প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
- লাইফস্টাইল পরিবর্তন: স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক সমস্যা দুরীকরনে ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে থাকে।
মানসিক রোগ হলে করনীয়
মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলি খেয়াল রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ:
- চিকিৎসা নেওয়া: মানসিক রোগ গুরুতর হলে অবশ্যই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিৎ। তিনি আপনাকে আপনার রোগের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে মানসিক অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে।
- সমস্যা শেয়ার করা: পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে সমর্থন মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে ও মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।
- সচেতন থাকা: মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা মানসিক সমস্যার ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করে থাকে।
মানসিক সমস্যা সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নোত্তর
এ অংশে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক সমস্যা সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নোত্তর সংযোজন করা হলো।
প্রশ্ন ১: মানসিক রোগের সাধারন লক্ষনগুলো কি কি?
উত্তর: মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলি বিভিন্ন রোগের ধরন অনুযায়ী ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে, এমন কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে যা লক্ষ্য করা উচিত। এই লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- অতিরিক্ত দুঃখ বা হতাশার অনুভূতি
- আগ্রহ বা আনন্দের অনুভূতির অভাব
- নিদ্রা বা খাওয়ার অভ্যাসের অস্বাভাবিক পরিবর্তন
- শক্তির অভাব বা ক্লান্তিবোধ
- মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগ বা চিন্তাভাবনা
- ফোকাস করতে বা সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা
- নিজের ক্ষতি করা, আত্মহত্যার চেষ্টা করা বা অন্যর ক্ষতি করার চিন্তাভাবনা
যদি আপনি এই লক্ষণগুলির মধ্যে কোনটি অনুভব করেন, তাহলে জরুরি ভিত্তিতে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন। তিনি আপনার লক্ষণগুলি নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসার পরিকল্পনা তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।
প্রশ্ন ৩: কি কি কারণে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে?
উত্তরঃ মানসিক সমস্যার কারণ অত্যন্ত জটিল এবং এখনও সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়নি। তবে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে জিনগত, পরিবেশগত এবং ব্যক্তিগত কারণগুলির সংমিশ্রণ এই সমস্যাগুলোর বিকাশে ভূমিকা পালন করে থাকে। এরকমই কিছু কারন নিচে উল্লেখ করা হলো।
জিনগত কারন; জিনগত কারণ হলো মানসিক সমস্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে একটি। যদি আপনার পরিবার বা বংশের কোনও এক বা একাধিক সদস্যের মানসিক সমস্যা থাকে, তাহলে আপনারও এই সমস্যাগুলি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আমাদের আরো কিছু আর্টিকেলঃ
- পা ফাঁটার কারন ও প্রতিকার
- ক্যান্সারের ঝুঁকি ও প্রতিরোধ
- মাদকের ভয়াবহতা ও প্রতিকার
- ঠান্ডা লাগা প্রতিরোধের ১০টি কার্যকর উপায়
পরিবেশগত কারণ; বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যার কারনেও একজন ব্যাক্তির মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এরকম কিছু পরিবেশগত কারন হলো;
- শিশুকালে নির্যাতন বা অবহেলা
- দীর্ঘস্থায়ী চাপ বা স্ট্রেস
- অতিরিক্ত পরিমানে মাদকদ্রব্য বা অ্যালকোহল গ্রহন
- খুব কাছের বা প্রিয় কোনো স্বজন হারানো
- কোনো বড় দূর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত কারণ; কিছু ব্যক্তিগত কারনেও মানসিক সমস্যা হতে পারে। যেমনঃ
- লো-কনফিডেন্স বা আত্মবিশ্বাসের অভাব
- অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম বা অতিরিক্ত দায়িত্ববোধ
- কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত মানসিক চাপ
আমাদের শেষ কথা
মানসিক স্বাস্থ্য একটি ব্যক্তির সামগ্রিক স্বাস্থ্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিরা তাদের জীবনে আরও ভালভাবে কাজ করতে সক্ষম হয় এবং তাদের সম্পর্কগুলিকে আরও সুখী করে তোলে। তবে শরীরের রোগের মতো মনের রোগ নিয়ে আমরা ততোটাও সচেতন নই।
আমাদের আজকের আর্টিকেলে, আমরা চেষ্টা করেছি মানসিক সমস্যা বিষয়ক কিছু গুরুত্বপুর্ন তথ্য উপস্থাপন করতে যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করবে। আশা করি আর্টিকেলটি পাঠকের উপকারে আসবে । এতক্ষন ধৈর্য্য সহকারে আমাদের সাথে থাকার জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।