মাদকের ভয়াবহতা এবং এর প্রতিকার|
মাদক একটি বড় সামাজিক ব্যাধি। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার নিজের এবং পরিবারের জন্য মারাত্বক কষ্টের কারন হয়ে থাকে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থতো হয়ই সাথে আর্থিকভাবেও ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি সমাজে বিভিন্নরকম সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। মাদকের মত বড় সমস্যাকে সমাজ থেকে দূরীভুত করতে দরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ ও সচেতনতা। আমাদের আজকের আর্টিকেলে আমরা মাদকের বিভিন্ন ভয়াবহ দিক ও এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করবো, যা একজন সচেতন ব্যাক্তি হিসেবে প্রত্যেকেরই জানা প্রয়োজন! তাহলে চলুন কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক আমাদের আলোচনা।
আলোচ্য বিষয়ঃ
- মাদকের ভয়াবহ দিক
- মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
- মাদক ও মাদকাসক্ত ব্যক্তি সম্পর্কিত সচেতনতামূলক কিছু প্রশ্নোত্তর
- আমাদের শেষ কথা
মাদকের ভয়াবহ দিক
মাদক সেবনের ফলে একজন ব্যাক্তি শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এ অংশে এসকল বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। নিচে মাদক সেবনের ফলে একজন ব্যাক্তির যেসকল ক্ষতি হতে পারে তা আলোচনা করা হলো।
শারীরিক ক্ষতি: মাদক সেবনের ফলে বিভিন্ন শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। দীর্ঘসময় ধরে মাদক সেবনের ফলে মস্তিষ্কের ক্ষতি, হার্ট এটাক, ফুসুফুস ক্যান্সার, কিডনি বিকলাঙ্গ, লিভার ক্যান্সারের মতো নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন মাদকের বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে।
কোনো কোনো মাদক গ্রহনের ফলে ব্যাক্তির ঘুম একেবারেই কমে যায় আবার কোনো কোনো মাদক গ্রহনের ফলে ঘুম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। একইভাবে কিছু কিছু মাদক গ্রহণের ফলে ক্ষুধামন্দা দেখা দেয় আবার কখনো কখনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্ষুধার পরিমান অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড় কথা এটাই যে মাদক সেবনের ফলে এতোটা শারীরিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যার দরুন একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যহত হয় এবং নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে একজন ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
মানসিক ক্ষতি: মাদক সেবনের ফলে একজন মাদকাসক্ত ব্যাক্তি বিভিন্ন শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিকভাবেও চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। মাদক সেবনের ফলে একজন ব্যক্তির উদ্বেগ, দূশ্চিন্তা ও বিষন্নতা দেখা দিতে পারে। একজন মাদকাসক্ত ব্যাক্তি বিভিন্ন মানসিক রোগ যেমন; মস্তিষ্ক বিকৃতি, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেশন, প্যানিক ডিসঅর্ডারসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মাদকাসক্ত একজন ব্যাক্তির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
সামাজিক ক্ষতি: একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি বিভিন্ন সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। মাদক সেবনের ফলে যেসকল সামাজিক ক্ষতি হতে পারে সেগুলো হলোঃ
- পারিবারিক বন্ধনের অবনতিঃ একজন মাদকাসক্ত ব্যাক্তি মাদক নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে পরিবারকে ভালোবাসার ও পরিবারের সাথে সময় কাটানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এছাড়া একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির আচরণে কিছু নেতিবাচক পরিবর্তন দেখা দেয়। ফলে মাদকাসক্ত ব্যক্তি ক্রমশই তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত ব্যাক্তির সংসারে সর্বদা পারিবারিক কলহ লেগেই থাকে। মাদকাসক্তি একজন ব্যাক্তির বৈবাহিক বিচ্ছেদের কারণ ও হতে পারে।
- কর্মক্ষেত্রে সমস্যাঃ একজন মাদকাসক্ত ব্যাক্তি মাদকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে ধীরে ধীরে কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ে, ফলে সেই ব্যক্তির পরিবার নানাভাবে সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।
- আইনি সমস্যাঃ মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার নেশার যোগান দিতে গিয়ে অনেকসময় অনেক অনৈতিক ও অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে, ফলে তাকে বিভিন্ন আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়।
মাদক সেবন একটি অপরাধ, তাই কোথাও মাদক সেবনরত অবস্থায় ধরা পড়লেও আইনি সমস্যায় পড়তে হয়।
আরো পড়ুন:
অর্থনৈতিক ক্ষতি: একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও তার পরিবার একসময় চরম অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। মাদকাসক্তের পরিবারে অনেকসময় আর্থিক অনটন লেগে থাকতে দেখা যায়। নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে একজন ব্যক্তি নানাভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। চলুন যে নেই কি কি কারণে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি আর্থিক অনটনের সম্মুখীন হয়।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার নেশার জন্য প্রচুর পরিমানে অর্থ ব্যয় করে থাকেন।
- একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি অনেকসময় বিভিন্ন অপরাধ্মূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ে বিধায় আইনি জটিলতার হাত থেকে বাঁচতে অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিক নানারকম কঠিন রোগে আক্রান্ত হতে পারে ফলে তার চিকিৎসা বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় হতে পারে।
- মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদকাসক্তি নিরাময় করতে কিছু নির্দিষ্ট চিকিৎসার প্রয়োজন হয় ফলে সেগুলোর জন্যও প্রচুর অর্থব্যয় হতে পারে।
মোটকথা এটাই যে, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার জীবনে নানাভাবে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এটি এমন একটি গুরুতর সমস্যা যা একজন ব্যক্তি বা তার পরিবারের জন্য চরম অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কারন হতে পারে।
মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
মাদকাসক্তি একটি জটিল রোগ যা একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন করে থাকে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও তার পরিবার ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে পড়ে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি চাইলেই খুব সহজে তার নেশা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেনা। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসা, অনুকুল সামাজিক পরিবেশ ও মাদকাসক্ত ব্যক্তির নিজস্ব প্রচেষ্টার প্রয়োজন। নিচে এসকল বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা হলো।
ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা: মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি প্রয়োজনীয় তা হলো মাসকাসক্ত ব্যক্তির নিজস্ব প্রচেষ্টা বা ইচ্ছা। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি যদি নিজে থেকে মাদক ছাড়তে না চায় তবে তাকে সেখান থেকে বের করে আনা খুবই মুশকিল। তাই মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করে তার নিজস্ব প্রচেষ্টা জাগিয়ে তুলতে হবে।
চিকিৎসা: মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ ধাপ হলো মাদক নিরাময় চিকিৎসা। মাদক নিরাময়ের চিকিৎসার জন্য একজন ব্যক্তিকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নেওয়া যেতে পারে। নিরাময় কেন্দ্রে ঔষধ, থেরাপি এবং কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে মাদকাসক্তি নিরাময় করা হয়।
সামাজিক পরিবেশ: একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে তার আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে পারিবারিক সহযোগীতা ও অনুকুল সামাজিক পরিবেশ খুবই প্রয়োজন। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজেই একজন ভুক্তভোগী, তাই সে যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে চায় তবে তার দিকে অবশ্যই সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
সচেতনতামূলক কিছু প্রশ্নোত্তর
এ অংশে আমাদের আজকের আর্টিকেল সম্পর্কিত কিছু গুরুত্তপূর্ণ প্রশ্নোত্তর সংযোজন করা হলো।
প্রশ্ন ১: মাদকাসক্তি কি?
উত্তরঃ মাদকাসক্তি হলো একধরনের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা যার দরুন একজন ব্যক্তি সেই নির্দিষ্ট মাদক গ্রহণের প্রতি তীব্র আকর্ষন অনুভব করে থাকে। এছাড়া মাদকের কিছু ক্যামিকেল রিয়াকশন হিসেবে ব্যক্তির শরীরে এমন কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়ে থাকে যা তাকে নিয়মিত মাদক গ্রহন করতে বাধ্য করে।
প্রশ্ন ২: কি কি কারণে একজন ব্যক্তি মাদকাসক্ত হতে পারে?
উত্তরঃ বিভিন্ন কারণে একজন ব্যক্তি মাদকের প্রতি আসক্ত হতে পারে। হতাশা, মানসিক দূশ্চিন্তা থেকে বাঁচতে অনেকেই মাদককে আপন করে নেয়। কিছু কিছু তরুণরা পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব, অসৎ সঙ্গ, প্রেমে বিচ্ছেদের মতো কারণে মাদকের দিকে ঝু্ঁকে পড়ে।
প্রশ্ন ৩: মাদকাসক্তি প্রতিরোধে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
উত্তরঃ মাদকাসক্তি প্রতিরোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে।
- মাদকদ্রব্যর অবৈধ উৎপাদন, চালান ও বিক্রয় রোধ করা
- শক্ত মাদক আইন তৈরি করা এবং আইনের শিথিলিতা রোধ করা
- মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলা
- মাদককে দূর্লভ করা
- মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পূনর্বাসন ব্যবস্থার উন্নতি করা
প্রশ্ন ৪: কোন বয়সের ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে?
উত্তরঃ সব বয়সের মানুষের মধ্যেই মাদকাসক্তি দেখা দেয়। তবে বর্তমানে তরুন যুবকদের মাদকের প্রতি বেশি আসক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ কৌতুহলবশত আবার কেউ বন্ধুদের প্ররোচনায় পড়ে এক-দুইবার মাদক গ্রহন করে ফেলে এবং পরবর্তিতে এটা তার নেশায় রুপান্তরিত হয়।
প্রশ্ন ৫: তরুণ ছেলে-মেয়েরা মাদকাসক্ত হয়ে গেলে তাদের পিতামাতার করনীয় কি?
উত্তরঃ তরুণ ছেলে-মেয়েরা মাদকাসক্ত হয়ে গেলে তাদের পরিবারের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো করতে হবে;
- সন্তানকে সহনশীল হয়ে ধৈর্য্য সহকারে মাদকের কুফল ও এর ভয়াবহ দিকগুলো সম্পর্কে বোঝাতে হবে।
- যত দ্রুত সম্ভব একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হতে হবে।
- অবস্থা বেশি গুরুতর মনে হলে একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র বা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে ভর্তি করানো যেতে পারে।
- তাকে শক্তি ও সাহস দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে আমরা তোমার পাশে আছি, তুমি নিশ্চয়ই মাদক থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে।
আমাদের শেষকথা
মাদকাসক্তি একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যধিগুলোর মধ্যে একটি। এটি ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। মাদক নামক ব্যাধির প্রতিকার ও প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, সমাজের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি। আমাদের আজকের আর্টিকেলে আমরা মাদকের ভয়াবহ বিভিন্ন দিক ও এর প্রতিকারের উপায়গুলো কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যার মাধ্যমে কিছুটা হলেও সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে অবদান রাখা যাবে বলে আশা করছি। আর্টিকেলটি প্রয়োজনীয় মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ও কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না যেন!