শীতে ত্বক ও চুলের পরিচর্যা
আসি আসি করে শীতকাল কিন্তু চলেই এলো!
শীতের আমেজ আমাদের মনে প্রফুল্লতা নিয়ে এলেও শীতের আবহাওয়ায় ত্বক ও চুল হয়ে পড়ে রুক্ষ ও শুষ্ক।
তাই শীতকালে ত্বক ও চুলের জন্য বাড়তি যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ত্বক ও চুল নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আজকের আর্টিকেলে আমরা শীতে ত্বক ও চুলের পরিচর্যা বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য,টিপস এবং প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে জানতে পারবো যা আমাদের ত্বক ও চুলকে শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার থেকে রক্ষা করবে।
আলোচ্য বিষয়
- ত্বকের যত্ন
- শীতে ত্বকের জন্য ফেসপ্যাক
- চুলের যত্ন
- প্রয়োজনীয় প্রশ্নোত্তর
- শীতে চুলের যত্ন বিষয়ক কিছু টিপস
- আমাদের শেষ কথা
ত্বকের যত্ন
শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ত্বক নিজের স্বাভাবিক আর্দ্রতা হারিয়ে খুব ড্রাই হয়ে পড়ে। ফলে স্কিনে চর্মরোগসহ নানারকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। শীতকালে ত্বকের যত্নে নিম্নলিখিত কাজগুলো করা যেতে পারে।
ত্বক পরিষ্কার রাখা: শীতকালে ত্বক পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন সকালে এবং রাতে মুখ ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। ত্বকের ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত ফেসওয়াশ, ক্লিনজার ব্যবহার করতে হবে। শীতে ত্বকের মরা চামড়া পরিষ্কারের জন্য নিজের স্কিন টাইপ অনুযায়ী ভালো মানের স্ক্রাব ব্যবহার করা খুবই জরুরি। স্ক্রাব স্কিনের মরা চামড়া পরিষ্কার করে, স্কিনকে ডিপ ক্লিন করে এবং স্কিনের উজ্জ্বলতা ধরে রাখে।
ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা: শীতকালে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া একটি বড় সমস্যা। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ত্বককে আর্দ্র রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই প্রতিদিন সকালে এবং রাতে ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। আপনার স্কিন টাইপ বুঝে একটি ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার বেছে নিন। আপনি যদি অয়েলি স্কিনের হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে ওয়াটার বেইজ এবং ড্রাই স্কিনের হলে অয়েল বেইজ ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার চেষ্টা করুন।
টোনার ব্যবহার করা: টোনার ত্বকের হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে, ত্বককে মসৃণ ও টানটান রাখতে সাহায্য করে। তাই শীতকালে প্রতিদিন সকালে এবং রাতে ত্বকে টোনার ব্যবহার করতে হবে।
সানস্ক্রিন ব্যবহার করা: অনেকেই ভেবে থাকেন যে সানস্ক্রিন শুধুমাত্র গরমেই ব্যবহার করতে হয়। তবে এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। শীতকালে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করতেও সানস্ক্রিন অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।
ত্বকের গভীর পরিচর্যা করা: সপ্তাহে একদিন সময় করে ত্বকের গভীর পরিচর্যা করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন ফেসপ্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে।
শীতে ত্বকের জন্য ফেসপ্যাক
শীতে ত্বকের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফেসপ্যাক ভালো কাজ করে থাকে। নিচে কয়েকটি সহজ ও কার্যকর ফেসপ্যাকের রেসিপি দেওয়া হল:
মধু ও বেসন ফেসপ্যাক: শীতে ত্বকের পরিচর্যায় মধু খুবই উপকারী। মধুর সাথে যদি একটুখানি বেসন মিক্স করে প্যাক বানিয়ে ব্যবহার করা যায় তাহলে খুবই ভালো হয়। মধু ও বেসন ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে এবং ত্বককে মসৃণ করে তোলে।
টমেটো ও লেবুর ফেসপ্যাক: টমেটোতে আছে ভিটামিন সি যা ত্বককে উজ্জ্বল করে। লেবু ত্বকের রুক্ষতা দূর করে এবং ত্বককে মসৃন করে তোলে।
নারকেল তেল ও হলুদ ফেসপ্যাক: নারকেল তেল ও হলুদ ফেসপ্যাক ত্বকের বলিরেখা দূর করে এবং ত্বককে টানটান করে তোলে।
অ্যালোভেরা জেল ও মধুর ফেসপ্যাক: অ্যালোভেরা জেল ও মধুর ফেসপ্যাক ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং ত্বককে সুস্থ রাখে।
এইতো গেলো বিভিন্ন ফেসপ্যাক। এবার চলুন দেখে নেই শীতে চুলের যত্নে কি কি করা যেতে পারে।
চুলের যত্ন
শীতে ত্বকের পাশাপাশি চুলেরও চাই এক্সট্রা যত্ন। নিচে শীতে চুলের যত্ন বিষয়ক কিছু টিপস শেয়ার করা হলো।
চুল পরিষ্কার রাখা: শীতকালে চুল পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তাহে কমপক্ষে ২-৩ দিন চুল ধুতে হবে।
চুলের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা: শীতকালে চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই সপ্তাহে ২-৩ দিন চুলে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। সেই সাথে ভালো মানের সিরামও ব্যবহার করা যেতে পারে।
চুলের কন্ডিশনার ব্যবহার করা: শীতে চুল অত্যন্ত রুক্ষ ও অমসৃণ হয়ে পড়ে। চুলে কন্ডিশনার ব্যবহার করলে চুল নরম ও মসৃণ হয়। তাই অন্তত শীতের সময় সপ্তাহে ২-৩ দিন চুলে কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে।
চুলের তেল ব্যবহার করা: শীতের আবহাওয়ায় চুল পড়া সমস্যা বেড়ে যায়। চুলে তেল ব্যবহার করলে চুলের গোড়া মজবুত হয় এবং চুল পড়া কমে। তাই সপ্তাহে ১-২ দিন চুলে তেল ব্যবহার করতে হবে।
চুলের গভীর পরিচর্যা করা: শীতে সপ্তাহে ১ দিন চুলের গভীর পরিচর্যা করতে হবে। এজন্য চুলের ট্রিটমেন্ট, স্পা করা যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্নোত্তর
নিচে শীতে ত্বকের যত্ন বিষয়ক কিছু বহুল জিজ্ঞাসিত প্রয়োজনীয় প্রশ্নোত্তর উপস্থাপন করা হলো।
প্রশ্ন ১: শীতে ত্বকের যত্নে কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হবে?
উত্তর: শীতে ত্বক অত্যন্ত শুষ্ক হয়ে যায়। তাই শীতকালে ত্বকের যত্নে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে:
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। পানি পান করলে শরীরের ভেতর থেকে আর্দ্রতা পাওয়া যায় এবং ত্বক আর্দ্র থাকে।
- প্রতিদিন গোসল করুন, তবে বেশি গরম পানিতে গোসল করবেন না। বেশি গরম পানিতে গোসল করলে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল বেরিয়ে যায় এবং ত্বক আরও শুষ্ক হয়ে যায়।
- গোসলের পর ত্বক ভালোভাবে মুছে নিন। ত্বক মুছতে নরম তোয়ালে ব্যবহার করুন।
- গোসলের পর ত্বকে ময়েশ্চারাইজার লাগান। ময়েশ্চারাইজার ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
- ত্বক পরিষ্কার করার জন্য মাইল্ড ক্লিনজার ব্যবহার করুন। ক্লিনজার ত্বকের প্রাকৃতিক তেল বের করে দেয় না।
- ঠোঁট ফেটে গেলে ঠোঁটে লিপ বাম লাগান। লিপ বাম ঠোঁটের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
- বাইরে বের হলে গ্লাভস, টুপি, মাফলার, স্কার্ফ ইত্যাদি পরুন। এগুলো ত্বককে ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন ২: শীতকালে ত্বকের জন্য কী কী ঘরোয়া উপাদান ব্যবহার করা যেতে পারে?
উত্তর: শীতে ত্বকের যত্নে ঘরোয়া উপাদান হিসেবে এলোভেরা জেল, ওটমিল, মধু, অলিভ অয়েল, নারিকেল তেল, লেবু, পাঁকা পেঁপে, টমেটো ইত্যাদি উপাদান ভালো কাজ করে থাকে।
প্রশ্ন ৩: শীতকালে চুলের যত্নে কি কি বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার?
শীতে চুলকে ভালো রাখতে কিছু বিষয় এড়িয়ে যেতে হবে। চুলের ন্যাচারাল কালার বজায় রাখুন। রাসায়নিক রঙ চুলের আর্দ্রতা কেড়ে নিতে পারে।
শীতে চুলে হেয়ার ড্রায়ার, হেয়ার কার্লিং আয়রন ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এগুলো চুলের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া যে-ধরনের হেয়ার সটাইল চুলকে ড্যামেজ করতে পারে সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
প্রশ্ন ৪: শীতকালে চুলের রুক্ষতা দূর করার জন্য কী হেয়ারপ্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে?
উত্তর: শীতে চুলকে মসৃন রাখতে এলোভেরা জেল, টকদই, মেথি, অলিভ অয়েল, কোকোনাট অয়েল ইত্যাদি দিয়ে হেয়ারপ্যাক তৈরি করে ব্যবহার করা যেতে পারে। নিচে কিছু কার্যকরী হেয়ারপ্যাক রেসিপি দেয়া হলো।
নারিকেল তেল ও ডিমের হেয়ারপ্যাক: এই হেয়ারপ্যাকটি চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং চুলকে নরম ও মসৃণ করে।
উপকরণ:
১ টেবিল চামচ নারিকেল তেলও ১টি ডিম
প্রস্তুত প্রণালী:
১. একটি বাটিতে নারিকেল তেল গরম করে নিন।
২. ডিম ভালোভাবে ফেটিয়ে নিন।
৩. নারিকেল তেল ও ডিম একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
৪. চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত হেয়ারপ্যাকটি লাগান।
৫. ১০-১৫ মিনিট পর শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলুন।
অলিভ অয়েল ও মধুর হেয়ারপ্যাক: এই হেয়ারপ্যাক চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং চুলকে উজ্জ্বল করে।
উপকরণ:
১ টেবিল চামচ অলিভ অয়েলও ১ টেবিল চামচ মধু
প্রস্তুত প্রণালী:
১. একটি বাটিতে অলিভ অয়েল গরম করে নিন।
২. মধু ভালোভাবে ফেটিয়ে নিন।
৩. অলিভ অয়েল ও মধু একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
৪. চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত হেয়ারপ্যাকটি লাগান।
৫. ১০-১৫ মিনিট পর শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলুন।
আমন্ড অয়েল ও অ্যালোভেরা জেলের হেয়ারপ্যাক: এই হেয়ারপ্যাক চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং চুলকে কোমল ও মসৃণ করে।
উপকরণ:
১ টেবিল চামচ আমন্ড অয়েল ও ১ টেবিল চামচ অ্যালোভেরা জেল
প্রণালী:
১. একটি বাটিতে আমন্ড তেল গরম করে নিন।
২. অ্যালোভেরা জেল ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
৩. আমন্ড তেল ও অ্যালোভেরা জেল একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
৪. চুলের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত হেয়ারপ্যাকটি লাগান।
৫. ১০-১৫ মিনিট পর শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলুন।
এই হেয়ারপ্যাকগুলো ব্যবহার করার আগে চুলের ধরন ও রুক্ষতার মাত্রা বিবেচনা করা উচিত। হেয়ারপ্যাকটি চুলে লাগানোর পর চুলে হ্যাট বা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখলে হেয়ারপ্যাকটি ভালোভাবে কাজ করবে।
শীতে চুলের যত্ন বিষয়ক কিছু টিপস
নিচে শীতে চুলের যত্ন বিষয়ক কিছু টিপস প্রদান করা হলো:
- শীতকালে চুল শুকানোর জন্য হালকা তাপমাত্রার ব্যবহার করতে হবে।
- শীতকালে চুলে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করা কমাতে হবে।
- শীতকালে চুলে বেশি হেয়ার স্টাইল করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- শীতকালে চুলে বেশি গরম জল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আমাদের শেষ কথা
প্রিয় পাঠক, আজকের আর্টিকেলে আমি শীতে ত্বক ও চুলের যত্ন নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় টিপস শেয়ার করার চেষ্টা করেছি যা ফলো করে এই শীতে আপনার ত্বক ও চুলকে প্রাণবন্ত রাখতে পারেন। আশা করি আর্টিকেলটি পাঠকের উপকারে আসবে। এতক্ষণ সাথে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।