ক্যান্সারের ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও প্রতিকার।
ক্যান্সার একটি মারাত্মক মরনঘাতী রোগ যা শরীরের যেকোনো কোষকে আক্রান্ত করতে পারে। কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিভাজনের ফলে এই রোগটির সৃষ্টি হয়ে থাকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষ ধীরে ধীরে শরীরের অন্যান্য সুস্থ কোষসমূহকেও আক্রান্ত করে ফেলে , ফলে রোগীর শরীরে বিভিন্নরকম শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। প্রানঘাতী এই রোগটি আক্রান্ত ব্যাক্তিকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়। ত্বক, স্তন, পাকস্থলী, ফুসফুস, জরায়ুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
প্রানঘাতী এই রোগকে পুরোপুরি দমন না করা গেলেও, কিছু সাধারন জ্ঞান ও সচেতনতা পারে এই রোগের ঝুঁকিকে হ্রাস করতে। আমাদের আজকের আর্টিকেলে আমরা ক্যান্সারের ঝুঁকি, এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করবো যা আমাদের এই রোগের প্রকোপ থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে বলে আশা রাখছি।
আলোচ্য বিষয়
- ক্যান্সার কি?
- ক্যান্সারের প্রকারভেদ
- ক্যান্সারের ঝুঁকিসমূহ
- ক্যান্সার প্রতিরোধ
- ক্যান্সারের প্রতিকার
- ক্যান্সার সম্পর্কিত কিছু গুরুত্তপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
- আমাদের শেষ কথা
ক্যান্সার কি?
ক্যান্সার একটি জটিল রোগ যা শরীরের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিভাজনের ফলে হয়ে থাকে। সাধারণত স্বাভাবিক কোষ একটি নির্দিষ্ট সময় পরে মারা যায় এবং নতুন কোষ এর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়। কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষগুলির ক্ষেত্রে ঘটে ব্যতিক্রম ঘটনা। ক্যান্সার কোষ এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনা। তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।কেন ক্যান্সার কোষসমূহ এত দ্রুত বৃদ্ধি পায় তার কারণ এখনও সম্পূর্ণরূপে জানা যায়নি। তবে, বিভিন্ন জিনগত এবং পরিবেশগত কারণ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
ক্যান্সারের প্রকারভেদ
ক্যান্সা্রের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। ক্যান্সারের উৎপত্তিস্থল অনুসারে ক্যান্সারকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যেমনঃ স্তন ক্যান্সার; যা স্তনে সৃষ্টি হয়, ফুসফুসের ক্যান্সার; যা ফুসফুসে সৃষ্টি হয় এবং লিভার ক্যান্সার লিভারে সৃষ্টি হয়।
ক্যান্সারকে আচরণ অনুসারেও বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। ক্যান্সারের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্যান্সার হল ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার । এটি শরীরের অন্যান্য অংশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিনাইন ক্যান্সার হল কম বিপজ্জনক ধরণের ক্যান্সার। এটি সাধারণত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে না।
ক্যান্সারের কিছু সাধারণ ধরন নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
- স্তন ক্যান্সার
- ফুসফুসের ক্যান্সার
- কোলন ক্যান্সার
- প্রোস্টেট ক্যান্সার
- লিভার ক্যান্সার
- ত্বকের ক্যান্সার
- ব্লাড ক্যান্সার (লিউকেমিয়া, লিম্ফো্মিয়া)
আরো পড়ুনঃ
ক্যান্সারের ঝুঁকিসমূহ
ক্যান্সারের ঝুঁকি বিভিন্ন জিনগত এবং পরিবেশগত কারণের উপর নির্ভর করে। কিছু সাধারণ ঝুঁকির কারণ হল:
- বয়স: বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় কেননা বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম থাকে।
- পারিবারিক ইতিহাস: যদি কোনো ব্যক্তির পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তাহলে তার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
- ধূমপান নেশাদ্রব্য গ্রহন: ধূমপান ও নেশাদ্রব্য গ্রহণ ফুসফুস ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, গলায় ক্যান্সার এবং অন্যান্য ধরণের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ।
- অতিরিক্ত ওজন: অতিরিক্ত ওজন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির কারনে কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং অন্যান্য ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
- শারীরিক পরিশ্রমের অভাব: নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম না করলেও কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং অন্যান্য ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সচল থাকে তাই ক্যান্সারের ঝুঁকিও কম থাকে।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্য: অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, যেমন প্রক্রিয়াজাত খাবার, রেড মিট, অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত খাবার, কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং অন্যান্য ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মিঃ: অতিরিক্ত সূর্যের আলো ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ: কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ, যেমন হেপাটাইটিস বি ওষুধ, লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
ক্যান্সার প্রতিরোধ
কয়েকটি জিনিস করা যায় যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
- ধূমপান ত্যাগ করুন। ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সার, মুখের ক্যান্সার, গলায় ক্যান্সার এবং অন্যান্য ধরণের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ।
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন। অতিরিক্ত ওজন কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং অন্যান্য ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং অন্যান্য ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য খান। স্বাস্থ্যকর খাদ্য, যেমন ফল, শাকসবজি এবং সম্পূর্ণ শস্য, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি থেকে বেঁচে থাকুন। অতিরিক্ত সূর্যের আলো ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- নিয়মিত স্ক্রিনিং পরীক্ষা করুন। কিছু ধরণের ক্যান্সার, যেমন স্তন ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সার, প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা হলে আরও কার্যকরভাবে চিকিত্সা করা যেতে পারে।
ক্যান্সারের প্রতিকার
ক্যান্সারের কোন নির্দিষ্ট প্রতিকার নেই। তবে, ক্যান্সার সনাক্ত করে এবং যথাসময়ে চিকিত্সা করে ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো যেতে পারে। ক্যান্সারের চিকিত্সার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ইত্যাদি।
ক্যান্সার সম্পর্কিত কিছু গুরুত্তপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
এ অংশে ক্যান্সার সম্পর্কে বহূল জিজ্ঞাসিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল।
প্রশ্ন ১: ক্যান্সার কি জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট?
উত্তরঃনা, ক্যান্সার জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট নয়। ক্যান্সার শরীরের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিভাজনের ফলে হয়। যখন শরীরের কোনো অংশের কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হয় তিওখন ক্যান্সার সৃষ্ট হয়।
প্রশ্ন ২ : ক্যান্সার কি সারিয়ে তোলা যায়?
উত্তরঃ যদিও বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক উন্নত, তথাপি সব ধরনের ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য নয়। ক্যান্সার পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যাবে কিনা তা নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরন, ক্যান্সারের অবস্থা ও সামগ্রিক স্বাস্থর উপর। তবে কিছু ধরণের ক্যান্সার, যেমন স্তন ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সার, যদি প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা হয় তবে সাধারণত সারিয়ে তোলা যায়।
প্রশ্ন ৩: ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য কোন টিকা আছে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু ধরণের ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য টিকা আছে। এই টিকাগুলি নির্দিষ্ট ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা হেপাটাইটিস বি-সম্পর্কিত লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন ৪: ক্যান্সার কি কোন ধরনের ছোঁয়াচে রোগ?
উত্তরঃ না,ক্যান্সার কোন ধরনের ছোঁয়াচে রোগ নয়। ক্যান্সার রোগীর সাথে থাকলে বা ক্যান্সার রোগীর সাথে চলাফেরায় ক্যান্সার ছড়ায় না। বরং ক্যান্সার মাইটোসিস কোষ বিভাজনের এক ধরনের অস্বাভাবিক বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয় যা একদমই ছোঁয়াচে নয়।
প্রশ্ন ৫: স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে মহিলারা কি কি পদক্ষেপ নিতে পারে?
উত্তরঃ স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
- যৌন মিলনের ক্ষেত্রে নিরাপদ থাকুন। অনিরাপদ যৌন মিলনের ফলে জরায়ু ক্যান্সারের ঝু্ঁকি বাড়ে।
- স্তন ও যৌনাঙ্গ যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখুন।
- প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার খান। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কামরাঙা, বড়ই, লেবু, পেয়ারা ইত্যাদিতে রয়েছে ভিটামিন সি।
আমাদের শেষ কথা
ক্যান্সার এমন একটি গুরুতর রোগ যা প্রতিদিন সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে বাঁচাতে দ্রুত ক্যান্সার সনাক্ত করা খুবই জরুরি। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনে রাখবেন:
- ধূমপান ত্যাগ করুন।
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন।
- নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্য খান।
- সূর্যের আলো থেকে রক্ষা করুন।
- নিয়মিত স্ক্রিনিং পরীক্ষা করুন।
ক্যান্সার হলেও আশা হারিয়ে ভেঙে পড়বেন না। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে ক্যান্সারের কারণে নিশ্চিত মৃত্যু এখন কমে এসেছে। যদি আপনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তবে একজন অভিজ্ঞ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত ফলোআপে থাকুন ও প্রয়োজনী চিকিৎসা নিন।
আমাদের আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা ক্যান্সার সম্পর্কিত কিছু সচেতনতামূলক বিষয় শেয়ার করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পাঠকের উপকারে আসবে। আমাদের সাথে ধৈর্য্য সহকারে সাথে থাকার জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি উপকারী মনে হলে পরিচিতদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।